বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৪৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মহানবী (সা.)-এর অনুপম আতিথেয়তা

ইজাজুল হক:

অতিথিপরায়ণতা ও মেহমানদারির আদর্শ ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। অতিথিদের সামনে তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। যেকোনো অতিথিকেই তিনি সাদর আমন্ত্রণ ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। অতিথিদের ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ ও শত্রু-মিত্রের ফারাক করতেন না। কোনো অতিথির কাছ থেকে অসৌজন্য প্রকাশ পেলেও ধৈর্য ধরতেন।

অতিথির আদর-আপ্যায়নে যাতে কোনো ত্রুটি না হয় সেদিকে সম্পূর্ণ খেয়াল রাখতেন। বিদায়বেলায় মেহমানের হাতে তুলে দিতেন বিভিন্ন রকম উপহার-উপঢৌকন। তার আন্তরিক আতিথেয়তায় অতিথিরা মুগ্ধ-বিস্মিত হতো। সেই মুগ্ধতা-বিস্ময় অনেক অতিথিকে ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করেছে। আতিথেয়তা সম্পর্কে তার নির্দেশনাবলি যুগ যুগ ধরে আভিজাত্যের আকাশে আলো ছড়াতে থাকবে।

আতিথেয়তার ফজিলত

মেহমানদারি ও আতিথেয়তার ফজিলত বর্ণনা করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানের সমাদর করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৯)

সালমান ফারসি (রা.) বলেন, একবার আমি রাসুল (সা.) এর কাছে এলাম। একটি বালিশে হেলান দিয়ে তিনি বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তিনি বালিশটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সালমান, যখন কোনো মুসলমান তার ভাইয়ের কাছে আসে, তখন তার সম্মানে যদি একটি বালিশও সে এগিয়ে দেয়, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।’ (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৬)

সর্বজনীন আতিথেয়তা

রাসুল (সা.)-এর আতিথেয়তার শর্তের কোনো বেড়াজাল ছিল না। ধনী-দরিদ্রের তফাৎ ছিল না। মুসলিম-অমুসলিমের তারতম্য ছিল না। শত্রু-মিত্রের কোনো ফারাক ছিল না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ওলিমায় শুধু ধনীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং গরিবদের বাদ দেওয়া হয়, তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৭৯৯)

এক সাহাবি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসুল, ধরুন আমি এক লোকের কাছে গেলাম কিন্তু সে আমাকে মেহমানদারি করল না। পরে সে যদি আমার মেহমান হয় আমি কী তাকে সমাদর করব, না তার মতোই আচরণ করব? রাসুল (সা.) জবাবে বললেন, ‘না, বরং তুমি তাকে মেহমানদারি করবে।’ (মিশকাত, পৃষ্ঠা : ৩৬৯)

সাহাবি রুশদ ইবনে আবদুর রহমান (রা.) বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণের আগে আমি রাসুল (সা.)-এর মেহমান হয়েছিলাম। তিনি আমার খোঁজ-খবর নিলেন। তার কাছে আমাকে বসালেন। যতক্ষণ আমি তার কাছে ছিলাম ততক্ষণ তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। তার এই অসাধারণ আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৭)

উষ্ণ অভ্যর্থনা

প্রিয়নবী (সা.) মেহমানদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। দরোজার বাইরে এসে কুশল বিনিময় করতেন। হাসিমুখে আন্তরিক অভিনন্দন জানাতেন। নিজের চাদর বিছিয়ে বসতে দিতেন। কখনো নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে মেহমানকে বসাতেন। মেহমানদের সঙ্গে কোনো শিশু এলে তাদের তিনি কোলে তুলে নিতেন এবং পরম মমতায় তার গালে চুমো এঁকে দিতেন।

হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মেহমানের আগমনবার্তা জানলে রাসুল (সা.) দরোজার বাইরে এসে তাকে অভ্যর্থনা ও সাদর সম্ভাষণ জানাতেন।’ (মিশকাত, পৃষ্ঠা : ৩৭০)

শত্রু যখন অতিথি

আরবের মুহারিব গোত্র খুবই উগ্র ছিল। তারা ছিল কট্টর ইসলামবিরোধী। ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে যখন মানুষ দলে দলে মদিনায় আসতে লাগল, তখন মুহারিব গোত্রেরও দশজন লোক মদিনায় এলো। রাসুল (সা.) তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নের জন্য বেলাল (রা.)-কে দায়িত্ব দেন। সকাল-বিকেল তাদের আহারের সুব্যবস্থা করেন। এতে তারা খুবই মুগ্ধ-বিস্মিত হলো এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজ দেশে ফিরে গেল। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৪)

অতিথির অসৌজন্যে ধৈর্য ধারণ

অতিথিদের নানা দুর্ব্যবহারে তিনি সহনশীলতার পরিচয় দিতেন। তাদের অসৌজন্য নীরবে সয়ে যেতেন। ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিতেন তাদের। একটু কটুবাক্যও তিনি কখনো বলতেন না। অন্যদেরও কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। একবার এক গ্রাম্য বেদুইন লোক নবী (সা.)-এর কাছে আসে। কিন্তু হঠাৎ সে মসজিদে নববীর ভেতরেই প্রস্রাব করতে শুরু করে। সাহাবায়ে কেরাম তাকে বাঁধা দিতে গেলে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে সুযোগ দাও এবং তার প্রস্রাবে এক বালতি পানি ঢেলে দাও। তোমরা অন্যের প্রতি কঠোর হওয়ার জন্য নয়, বরং নম্র ব্যবহারের জন্যে প্রেরিত হয়েছো।’ (বুখারি, হাদিস : ২২০)

মেহমানের খাতির-যত্ন

অতিথির আদর-আপ্যায়ন ও খাতির-যত্নে রাসুলের কোনো সংকোচবোধ ছিল না। তিনি মেহমানের সঙ্গে একই পাত্রে বসে খেতেন। মেহমান তৃপ্তিসহকারে খেয়ে না ওঠা পর্যন্ত তিনি উঠতেন না। বসে থাকতেন। ভালো খাবারগুলো মেহমানে দিকে এগিয়ে দিতেন। খাবার সংকট থাকলে নিজের পরিবারকে অভুক্ত রেখে তিনি মেহমানদের খাওয়াতেন।

‘আসহাবুস সুফফার (যারা মসজিদে নববীতে থাকতেন, তাদের বাড়ি-ঘর ছিল না) সদস্যরা ছিলেন রাসুল (সা.) এর নিত্য মেহমান। তিনি তাদের খাতির-যতেœর কোনো কমতি রাখতেন না। অন্যান্য মেহমানদের তিনি আসহাবুস সুফফার সঙ্গে মসজিদে নববীতে থাকার ব্যবস্থা করতেন। তাছাড়া সাহাবি রামলা ও উম্মে শরিক (রা.)-এর ঘরেও মেহমানদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। (শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ, খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৮০)

এতেও সংকুলান না হলে তিনি সাহাবাদের মধ্যে মেহমানদের বণ্টন করে দিতেন। তাদের খাতির-যত্নের তাগিদ দিতেন। সাহাবারাও তাদের সমাদর করতেন।

মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় অতিথির কোনো অভাব ছিল না। রাসুল (সা.) নিজেই তাদের খেদমত আঞ্জাম দিতেন। আর সাহাবি বেলাল (রা.)-কে রাষ্ট্রীয় মেহমানদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। (সিরাতুন নবী, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৫০৪)

অতিথির সঙ্গে হাস্যরস

রাসুল (সা.) বলেন, ‘মেহমানের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা এবং কথা বলা সাদাকাহ। (তিরমিজি, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা: ১৮)

মেহমানের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ হয়ে আলাপ করতেন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস করতেও ভুলতেন না। একবার এক মেহমান বলল, আল্লাহর রাসুল, আমার কোনো বাহন নেই। চড়ার জন্যে আমাকে বাহন দিন। রাসুল (সা.) তাকে কৌতুক করে বলেন, তোমাকে একটি উটের বাচ্চা দেব। লোকটি বলল, উটের বাচ্চা দিয়ে আমি কী করব হে আল্লাহর রাসুল? রাসুল (সা.) বললেন, এমন কোনো উট আছে কী, যা কোনো উটের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়নি? (তিরমিজি, খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২০) অর্থাৎ উটের বাচ্চা মানে তাকে উট দেওয়ার কথাই বলেছেন রাসুল (সা.)।

বিদায়কালে উপহার

রাসুল (সা.) বিদায়কালে মেহমানদের পথখরচ ও উপহার দিতেন। কখনো পর্যাপ্ত উপহার দিতে না পারলে অল্প হলেও দিতেন। তাদের কাছে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করতেন। কখনো বিশেষ সাহাবিকে বলে দিতেন, যাতে তিনি তাদের পথখরচ দিয়ে দেন। অন্যান্য উপহার তো থাকতই। বিশেষত যখন কেউ তার কাছে উপহার নিয়ে আসতেন, তখন তিনি তা গ্রহণ করতেন। পাশাপাশি বিদায়কালে তাকে নিজের পক্ষ থেকে অবশ্যই উপহার দিতেন।

হারিস ইবনে আউফের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল একবার রাসুল (সা.)-এর অতিথি হয়। বিদায়কালে রাসুল (সা.) তাদের প্রত্যেককে ১০ উকিয়া পরিমাণ রুপা দেন। সাহাবি হারিসকে দেন ১২ উকিয়া পরিমাণ রুপা। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৩)

মহানবী (সা.)-এর আতিথেয়তা মুসলমানদের অনুপম আদর্শ। আধুনিক যুগেও এসব সুন্নাত আভিজাত্যের নিদর্শন। এসব সুন্নাহ থেকে মুসলমানরা নিত্যদিন দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আসুন, অতিথি ও মেহমানের সমাদর করি। তাদের আদর-যত্ন ও খাতির-আপ্যায়নে মহানবী (সা.)-কে অনুসরণ করি। পৃথিবিময় ছড়িয়ে দেই ইসলামের সৌন্দর্য-মাধুর্য। সূত্র-দেশরূপান্তর।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION